পুরী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
পুরী ভ্রমণ, এই শব্দটি আপামর বাঙালী হৃদয়ে বরাবর ই একটি সেন্টিমেন্টের জায়গা, তা সে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেব দর্শন উদ্দেশ্যেই বলুন অথবা সমুদ্র সৈকত দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রেই হোক। এমন বাঙালী সত্যিই খুঁজে পাওয়া দুস্কর যার পুরী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির বা সমুদ্র সৈকত নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। চার ধামের মধ্যে অন্যতম ধাম হিসাবে বিবেচিত পুরী বা শ্রীক্ষেত্র ধাম সকল হিন্দু ব্যক্তির জন্য অবশ্যই দর্শনীয়। আর পুরীর সমুদ্রে সৈকতের খ্যাতি তো ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক বারংবার ছুটে আসেন পুরীর অপূর্ব নয়নাভিরাম সমুদ্রতটের টানে টানেই।
![]() |
পুরী ভ্রমণ গাইড । পুরী সাইড সিন। পুরী জগন্নাথ মন্দির |
পুরী জগন্নাথ মন্দিরঃ
হিন্দু ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে পুরীর মূল আকর্ষণ বিশ্ববিখ্যাত পুরীর জগন্নাথ মন্দির। যা পুরী রেলওয়ে জংশন থেকে মাত্র ২.৫ কিমি দূরে অবস্থিত। রাজা অনন্ত বর্মণ এর শাসনকালে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এই মন্দিরের আর তার ছেলের শাসনকালে ১১৬১ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে বিরাজ করেন জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম। এরপর বংশ পরম্পরা ক্রমে এই মন্দিরের উন্নয়ন কার্য চলতে থাকে। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা এই তিন মূর্তির পুজা হয় এই মন্দিরে। প্রতিদিন সকালে সাত রকম খাবার দিয়ে বাল্য ভোগের আয়োজন করা হয়। এরপর সকাল ১০ টায় তেরো রকমের ভোগ দেয়া হয়। একইভাবে দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করা হয় আর রাত আট টায় সন্ধ্যা আরতির পর রাতের খাবার নিবেদন করা হয়। প্রভু জগন্নাথ কে নিবেদন করা ভোগ প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়। জগন্নাথ ধাম পুরী হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য এক মহাপুন্যভুমি হিসেবে পৃথিবী খ্যাত।
চারধামের মধ্যে বদ্রীনাথ, দ্বারকা, রামেশ্বরম ও পুরী রয়েছে। এই পবিত্র মন্দিরের এতই মাহাত্ম্য
যে মন্দির দর্শনের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক ও ভক্তবৃন্দরা ছুটে আসেন সারা বছরই। এই মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশাধিকার একেবারেই নেই। পুরীর
জগন্নাথ মন্দিরে শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের মন্দির ছাড়াও আরও অনেক দেব-দেবীর মন্দির
রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল বিমলা মন্দির যা সতীর একান্ন পীঠের
অন্যতম শক্তিপীঠ। এখানে বিশ্বাস করা হয় যে মাতা বিমলা হলেন দেবী মায়ের তান্ত্রিক
প্রকাশ।
পুরী ভ্রমণ গাইড
পুরী পৌছাবেন কিভাবে?
আকাশপথেঃ নিকটতম বিমান বন্দরটি হল ভূবনেশ্বর বিমান বন্দর
বর্তমানে যা বিজু পট্টনায়ক বিমান বন্দর নামে পরিচিত এটি পুরী থেকে প্রায় ৬০কি.মি
দূরে অবস্থিত। বিমান বন্দরে পৌছে স্থানীয় পরিবহনে মাধ্যমে আপানেকে গন্তব্যে পৌছাতে
হবে।
ট্রেনপথেঃ
পুরী নিজস্ব নামের ই ষ্টেশন রয়েছে, যা ভারতের অন্যতম শহরগুলি সাথে ভালভাবে সংযোগ
সাধন করে। ষ্টেশনে পৌছে আপনাকে স্থানীয় পরিবহন মাধ্যমের উপর ভরসা করতে হবে।
সড়কপথেঃ সড়ক পথে পুরী ভারতের অন্যান্য শহরগুলির সাথে ভালোভাবে সংযোগ সাধন করে। আপনি আন্তঃরাজ্য বাস, প্রাইভেট বাস অথবা প্রাইভেট গাড়ীতে পুরী পৌছাতে পারেন।
![]() |
পুরী ভ্রমণ গাইড।পুরী সাইড সিন।পুরী জগন্নাথ মন্দির | Puri |
পুরী সাইড সিন
নন্দন কানন, চিলকা, কোনার্ক, উদয়গিরি-খন্ডগিরি, গুণ্ডিচা মন্দির (মাসীর বাড়ী)
ব্যতীত, বিশেষ আরও কিছু আকর্ষণীয় ঘোরার
জায়গা রয়েছে পুরীতে –
গোল্ডেনবিচঃ বর্তমানে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে শান্ত নিরিবিলি এই বিচটি যার অপর
নাম ব্লু ফ্ল্যাগ বিচ। এখানে ঢোকার জন্য টিকিট কাটা আবশ্যক।
এখানে বসার সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। স্নান করতে চাইলে তার টিকিট মূল্য আলাদা,
স্নানের পর পোশাক পরিবর্তন জায়গা আছে, আছে খাবার রেষ্টুরেন্ট ও।
![]() |
পুরী ভ্রমণ গাইড।পুরী সাইড সিন।পুরী জগন্নাথ মন্দির | Puri |
চন্দকা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারীঃ পুরী থেকে
মাত্র ঘন্টা দেড়েকের দূরত্বে রয়েছে এটি। এখানে টিকিট মূল্যের বিনিময়ে জঙ্গল
সাফারীর ব্যবস্থা আছে।
মার্কাণ্ডেশ্বর মন্দিরঃ এই মন্দিরে মহাদেব অধিষ্ঠিত। পুরী বেড়াতে গেলে জগন্নাথ
মন্দির, সৈকত, চিল্কা ছাড়াও এই মন্দির দর্শনের কথা ভুলবেন না
যেন। পুরীর খুব কাছেই এই মন্দিরটি অবস্থিত। মার্কাণ্ডেশ্বর রাস্তার পাশে এই
মন্দিরটি স্থাপিত। পুরীর পঞ্চতীর্থের মধ্যে এটি অন্য়তম। ভারতে ৫২টি শিবের পবিত্র
স্থানের মধ্যে মার্কাণ্ডেশ্বর মন্দির অন্যতম বলে পরিচিত। প্রসঙ্গত, এই মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল, দশহাত যুক্ত নটরাজের বিশালাকার মূর্তি।
লাইট হাউসঃ স্বর্গদ্বার থেকে মাত্র দেড়
কি.মি. দূরে পূরীর মোহনা দেখতে যাওয়ার পথে মেরিন ড্রাইভ রোডের উপর রয়েছে
লাইট হাউস। এখানে টিকিট কেটে বিকেল সাড়ে ৪টে থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে প্রবেশ করা যায়।
এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব।
সূদর্শন ক্রাফ্ট মিউজিয়ামঃ পুরীর স্টেশন রোডের কাছেই রয়েছে সুদর্শন ক্রাফ্ট মিউজিয়াম।
মূল স্টেশন থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে। ১৯৭৭ সালে এই জাদুঘরটি তৈরি করেন বিখ্যাত
শিল্পী শ্রী সূদর্শন সাহু।স্থানীয় ও রাজ্যের বিভিন্ন শিল্পকীর্তি এই জাদুঘরে গেলে
পরিচয় ঘটবে। জানা যাবে অজানা অচেনা তথ্য। বিশিষ্ট শিল্পী সুদর্শন সাহুর নিজহাতে
তৈরি করা কাঠের তৈরি শিল্প, পাথের উপর খোদাই করা নিদর্শন, ফাইবারগ্লাসের তৈরি হ্যান্ডক্রাফ্ট-সবই দেখতে পাবেন এখানে।
রঘুরাজপুর গ্রামঃ এই গ্রামে প্রতিটি ঘরে ঘরে চলছে পটচিত্র তৈরীর কাজ।
উড়িষ্যার বিখ্যাত পটচিত্র তৈরী চাক্ষুস
দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে এই গ্রামটিতে।
আথারানালা ব্রিজঃ পুরীর
অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল এই প্রাচীন ব্রিজ। ১৩ শতকে গঙ্গার রাজা ৮৫ মিটার দীর্ঘ
ব্রিজটি নির্মাণ করেন। গোটা ব্রিজটিই একটি প্রত্নতাত্ত্বিক হেরিটিজ হিসেবে পরিচিত।
শীতকালে এই ব্রিজের সৌন্দর্য দেখতে ভিড় করেন বহু পর্যটক।
পুরীর বিশেষত্ব রথযাত্রা উৎসবঃ রথযাত্রা বললেই, সবার
আগে মনে পড়ে ওড়িশা রাজ্যের পুরীর জগন্নাথের রথের কথা। এখানের রথযাত্রা বিশ্বখ্যাত। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয় রথযাত্রা উৎসব। তবে, এই রথযাত্রা ও রথের বিশেষত্ব আছে। পুরীর জগন্নাথ দেবের দর্শন পেতে সারা বছর
জুড়েই পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। তবে, বছরের এই বিশেষ সময়ে, অর্থাৎ
রথযাত্রা উৎসবকে কেন্দ্র করে এখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। দেশ এমনকি দেশের
বাইরে বিদেশ থেকেও বহু মানুষ পুরীতে আসেন রথযাত্রা উৎসব দেখতে।
![]() |
পুরী ভ্রমণ গাইড।পুরী সাইড সিন।পুরী জগন্নাথ মন্দির | Puri |
পুরীতে কোথায় থাকবেন ও খাবেন ?
পুরীতে থাকার জন্য প্রচুর হোটেল, রির্সোট, লজ, গেষ্ট হাউস,
হলিডে হোম ও হোমষ্টে আছে। যার ভাড়া মোটামুটি সর্বনিম্ন ৩০০টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০০টাকা
অবধি। বেশ কিছু হোটেল, গেষ্ট হাউসে নিজেদের রান্না করে খাওয়ার সু-ব্যবস্থাও আছে।
পুরীতে সারা বছরই প্রচুর বাঙালী পর্যটকের আগমন ঘটে তাই বাঙালী খাবার পাওয়া যায়
এমন ভাতের হোটেলও অসংখ্য এছাড়া আপনি নর্থ ইন্ডিয়ান, সাউথ ইন্ডিয়ান, চাইনিজ্-কন্টিনেন্টাল
সব সবরকমই খাবার পাবেন। সন্ধ্যাবেলা পুরীর সীবিচে নানা ধরণের স্ট্রীট ফুড বিক্রিও
চলছে রমরমিয়ে তার মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে বিভিন্ন স্বাদের গরম মাছ ভাজা আপনি যদি মৎস
প্রেমী হন তাহলে এই মাছ ভাজার স্বাদ একবার আস্বাদন করে দেখতেই পারেন।
![]() |
পুরী ভ্রমণ গাইড।পুরী সাইড সিন।পুরী জগন্নাথ মন্দির | Puri |
পুরী, ওড়িশার একটি শহর। বহু বাঙালি ও দেশ-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা এখানে। সমুদ্র সৈকত হল পুরীর প্রধান আকর্ষণ। বঙ্গোপসাগরের তীরে এই সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার ইচ্ছে যে কোন বাঙ্গালীর হৃদয়ে বিদ্যমান।
প্রাচীন মন্দির ব্যাতীত, সমুদ্রের সুবিশাল ঢেউ, পুরীর বিখ্যাত গজা, কটকি শাড়ি আর ঝিনুকের তৈরী ঘর সাজানোর
রকমারী জিনিষ এর সঙ্গে বাঙালি হৃদয়ের এক নিবিড় সম্পর্ক। পুরীর স্বর্গদ্বারের
আশেপাশে সুবিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে এরই মার্কেট চত্বর।
![]() |
পুরী ভ্রমণ গাইড।পুরী সাইড সিন।পুরী জগন্নাথ মন্দির | Puri |
অফিসের অথবা ব্যবসার চাপ কমাতে, পরিবারের সঙ্গে একান্তে ছুটি কাটানোর জন্য বাঙালির মনে দীঘার পরই পুরীর কথাই মনে আসে বারংবার।
বিঃদ্রঃ- শোনা যাচ্ছে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে জারি হচ্ছে আরও
এক নিয়ম। পুরীর ঢোকার ক্ষেত্রে ভক্তদের জন্য চালু হতে চলেছে নতুন নিয়ম যেখানে
জানানো হতে চলেছে যে, হাফ প্যান্ট, ছেঁড়া জিন্স, স্কার্ট এবং স্লিভলেস পোশাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন না
ভক্তরা। শালীনতা
বজায় রেখে পোশাক পরিধানের বিষয়টি ভক্তদের বিবেচনা বোধের উপর রেখেছেন জগন্নাথ
মন্দির কর্তৃপক্ষ।
উঃ শ্রীক্ষেত্র বা নীলাচল পুরীর অপর নাম।
প্রঃ- পুরী কোন জেলা অবস্থিত?
উঃ পুরী ভারতবর্ষের উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত ৩০টি জেলার মধ্যে অন্যতম একটি জেলা পুরী।
প্রঃ পুরী হোটেল ভাড়া
উঃ পুরী হোটেল ভাড়া মোটামুটি সর্বনিম্ন ৩০০টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০০টাকা অবধি
প্রঃ পুরীর সমুদ্রেে ওপারে কি আছে
উঃ পুরীর সমুদ্রের ওপারে রয়েছে মায়নমার (বার্মা) দেশ।
প্রঃ পুরীর মন্দির কত বছর পুরানো?
উঃ আনুমানিক ১১৬১ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির
0 মন্তব্যসমূহ