তুলসী শব্দের অর্থ অতুলনীয়
তুলসী
শব্দের অর্থ যার তুলনা নেই, অতুলনীয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তুলসী একটি অতি
পবিত্র উদ্ভিদ এটি বৃন্দা নামেও
পরিচিত, হিন্দুরা এটিকে স্বর্গের প্রবেশদ্বার বা
বৈকুণ্ঠ, ঈশ্বরের আবাস বলে বিশ্বাস করে। তুলসী গাছ ভক্তদের ঈশ্বরের
কাছাকাছি যেতে বা মোক্ষ (সংসার থেকে মুক্তি, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের
চক্র) অর্জনে সহায়তা করে। পুরাণ ও বেদে
তুলসীকে লক্ষী, সীতা, বিষ্ণুপ্রিয়া, কল্যাণী রূপে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তুলসী
গাছকে ওষধি গাছের রাণীও বলা হয়। তুলসী গাছ বিপুল পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করে, তাই
একে অক্সিজেনের ভান্ডার ও বলা হয়।
তুলসী গুল্ম
প্রকৃতির উদ্ভিদ, এর উচ্চতা ৩ফুটের মত হয়। সারা বছরই তুলসী গাছে সবুজ পাতার সমাহার
দেখা যায়, এর পাতার কিনারা খাঁজ কাটা বিশিষ্ট এবং এর পাতা, ফুল ফল ঝাঁঝালো গন্ধ
বিশিষ্ট। জুলাই-আগষ্ট অথবা নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে তুলসী গাছে মঞ্জুরী হতে দেখা
যায়।
আজকের এই লেখনীতে
আলোচনা করব, তুলসী গাছের ধর্মীয় ও বাস্তু-র বিষয় সম্পর্কে।
![]() |
তুলসী গাছের উপকারিতা। তুলসী গাছ বাড়ীর কোন দিকে রাখা উচিত |
তুলসী গাছের ধর্মীয় গুণাগুণ ও বাস্তুসম্মত দিক
হিন্দুধর্ম অনুসারে তুলসী গাছ অত্যন্ত পবিত্র। মনে করা হয়
তুলসী গাছে স্বয়ং লক্ষ্মী ও নারায়ণের বাস। সেই কারণে তুলসী গাছকে গৃহস্থ বাড়িতে
রেখে প্রতিদিন এর পুজো করার বিধি আছে শাস্ত্রে। প্রতিদিন ভক্তিভরে তুলসী গাছের
পুজো করলে শ্রীবিষ্ণু যেমন খুশি হন, তেমনই এর ফলে তুষ্ট হয়ে
আশীর্বাদ বর্ষিত করেন মা লক্ষ্মী। ধর্মীয় দিক থেকে তুলসী গাছের যেমন বিশেষ
মাহাত্ম্য রয়েছে, তেমনই বৈদিক জ্যোতিষেও তুলসী গাছ অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। গৃহস্থ
বাড়ীতে তুলসী গাছের বিভিন্ন অংশকে দেবতাদের বাসস্থান বলে মনে করা হয়। উপরন্তু, তুলসীকে দেবী লক্ষ্মীর শারীরিক অবতার বলে মনে করা হয়। এইভাবে সমৃদ্ধি ও
শান্তির জন্য প্রতিদিন স্নানের পরে তুলসী গাছের পূজা করা হয়। বাড়িতে একটি তুলসী
গাছের উপস্থিতি নেতিবাচক শক্তি নির্মূল করতে বা মন্দ থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করে।
প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ অনুসারে, বাড়িতে একটি তুলসী গাছ
থাকলে সম্পদ এবং সৌভাগ্য আকর্ষণ করতে পারে। এটি দেবী লক্ষ্মীর মূর্ত প্রতীক, সম্পদের দেবী বলে বিশ্বাস করা হয়।
আরও পড়ুনঃ তুলসী পাতার ঔষধি গুণাগুণ
মনে করা হয় যে তুলসী স্বর্গ বা বৈকুণ্ঠে পৌঁছানোর বাহন।
তাছাড়া, মোক্ষসিদ্ধির চূড়ান্ত লক্ষ্যের জন্য তুলসী খুবই উপকারী।
মোক্ষ হল মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়, যার জন্য সৃষ্টির প্রতিটি জীব আকাঙ্ক্ষা করে।
হিন্দুরাও 'শুক্লপক্ষে' একাদশী বা কার্তিক মাসের একাদশ দিনে তুলসী পূজা করে। এই দুই দিনেই তুলসী গাছের
বিয়ে হয় ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গে। তুলসী গাছটি নববধূর মতো সজ্জিত করা হয়। অন্যদিকে বৈষ্ণব দর্শন অনুসারে, তুলসী গাছের পাতা ভগবান বিষ্ণুকে সবচেয়ে বেশি খুশি করেন। বৈষ্ণবরা বিষ্ণু
মন্ত্র পাঠ করার সময় একটি তুলসী মালা ব্যবহার করে কারণ তারা মনে করেন তুলসী গাছ
তাদের ভগবান বিষ্ণুর কম্পন এবং আত্মার সাথে
সামঞ্জস্যপূর্ণ সাহায্য করে।
বাস্তু অনুসারে, তুলসী
গাছ সবসময় বিজোড় সংখ্যায় লাগাতে হবে। আপনি 1,3,5
উদ্ভিদ থাকতে পারে, এবং
তাই বাড়ির উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিক এই ভেষজ গাছ লাগানোর জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা
বলে মনে করা হয়। এটি যেখানে সর্বাধিক ইতিবাচক শক্তি আকর্ষণ করে।
এটি বিশ্বাস করা হয় যে বৃহস্পতিবার ভগবান
বিষ্ণুর দিন এবং তুলসিকে বিষ্ণুপ্রিয়া রূপে পূজা করা হয়। তাই বৃহস্পতিবার বাড়িতে
তুলসি গাছ লাগালে ভগবান বিষ্ণুর দিন এবং তুলসিকে বিষ্ণুপ্রিয়া রূপে পূজা করা হয়।
তাই বৃহস্পতিবার বাড়িতে তুলসি গাছ লাগালে ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদ সবসময় আপনার
ওপর থাকে। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে,
কার্তিক মাসটিকে এই গাছ
লাগানোর জন্য সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়। এই মাস জুড়ে তুলসি গাছের পুজো করা হয় এবং এর সামনে একটি প্রদীপ
জ্বালানো হয়।
আরও পড়ুনঃ বাস্তু শাস্ত্র কাকে বলে
এটি ডাস্টবিন, জুতা বা ঝাড়ুর কাছে রাখা উচিত নয়। পরিবর্তে, আপনার ফুলের গাছের কাছে একটি তুলসী গাছ বপন করা উচিত। একইভাবে, তুলসীকে ক্যাকটাস বা কাঁটাযুক্ত গাছের কাছে লাগানো উচিত নয়। এটি আদর্শভাবে একটি পাত্রে রোপণ করা উচিত, মাটিতে নয়।
![]() |
তুলসী গাছের উপকারিতা। তুলসী গাছ বাড়ীর কোন দিকে রাখা উচিত |
যে পাত্রে তুলসি গাছ লাগানো হয় তার মাটিও এত পবিত্র বলে বিবেচিত হয়, ফলে তাতে আবার তুলসি গাছ লাগানো যায়। কোনও কারণ ছাড়াই তুলসি গাছের ডাল উপড়ে নেওয়া বা কাটা উচিত নয়। যদি গাছটি শুকিয়ে যায় তবে সঠিক ধর্মীয় আচারের সঙ্গে শুকনো গাছটিকে নদীতে ফেলে দিন। শুকনো তুলসি গাছ কখনওই ঘরে রাখা উচিত নয়। এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে যে ব্যক্তি নিয়মিত তুলসিকে জল দেয় সে আর্শীবাদ লাভ করে।
দাম জানতে ক্লিক করুণ
জ্যোতিষে তুলসি গাছের কয়েকটি টোটকার কথা উল্লেখ আছে। এই টোটকাগুলি মেনে চললে যেমন মা লক্ষ্মী যেমন আপনার উপর সদয় হবেন, তেমনই সদয় হবেন সম্পদের দেবতা ধনকুবের।
তুলসী গাছের পাতা ও মূল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুলসী গাছের
গোড়ায় স্বয়ং শালিগ্রামের বাস থাকে। তাই তুলসী গাছের গোড়ায় প্রতিদিন জল ঢাললে
অর্থভাগ্য আপানার অবশ্যই খুলে যাবে।
![]() |
তুলসী গাছের উপকারিতা। তুলসী গাছ বাড়ীর কোন দিকে রাখা উচিত |
প্রতিদিন তুলসী গাছের পুজো করার সময় তুলসী গাছের সামনে 'ওম নম ভগবতে বসুদেবায় নমহঃ' মন্ত্র জপ করুন ১০৮ বার।
সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে চাইলে আটা দিয়ে তৈরি একটি প্রদীপে
ঘি ঢেলে সেই প্রদীপ সন্ধেবেলা তুলসী গাছের গোড়ায় জ্বালিয়ে দিন। মনে রাখবেন এই
প্রদীপ যেন উত্তর দিকে মুখ করে জ্বালানো হয়। এর মধ্যে এক চিমটে হলুদ দিয়ে তুলসী
গাছের গোড়ায় রেখে দিন।
রবিবার ভুলেও তুলসী গাছ স্পর্শ করবেন না। এছাড়া বুধবার ও
একাদশীতেও তুলসী গাছ স্পর্শ করতে নেই। এছাড়া তুলসী তলায় প্রদীপ দেখানোর সময়ও
ভুলেও তুলসী গাছ স্পর্শ করবেন না।
একাদশী তিথিতে তুলসী গাছে একটু গুড় নিবেদন করুন। এর ফলে
সৌভাগ্যলক্ষ্মী আপনার প্রতি সদয় হবেন, আপনার দুর্ভাগ্য দূর হবে।
এছাড়াও, তুলসি গাছকে সনাতন ধর্মে বিভিন্ন দেবতা এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থের প্রতিনিধি
হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, তুলসি গাছ মানুষের মনে
শান্তি দিতে পারে।
আরও পড়ুনঃ- ফেংশুই বাস্তু টিপস্
তুলসী পাতার কিছু প্রতিকার
১) তুলসী পাতা শুকিয়ে গেলে সেই পাতাগুলো স্নানের জলে
ব্যবহার করতে পারেন। স্নানের জলে তুলসী পাতা রাখলে নেতিবাচক শক্তি শরীরের মধ্যে
প্রবেশ করে না। এছাড়াও, যদি
ভগবান কৃষ্ণের শিশু রূপের পূজা করে থাকেন তাহলে তাতে শুকনো তুলসী পাতা ব্যবহার
করতে পারেন।
![]() |
তুলসী গাছের উপকারিতা। তুলসী গাছ বাড়ীর কোন দিকে রাখা উচিত |
২) দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পেতে, একটি লাল রঙের
কাপড়ে শুকনো তুলসী পাতা বেঁধে যেখানে সম্পদ রাখেন সেখানে রেখে দিন। এতে লক্ষ্মীর
কৃপা বজায় থাকে। আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। আগের তুলনায় অর্থনৈতিক
অবস্থার উন্নতি হয়।
৩) সকালে ঘুম থেকে উঠে তুলসী পাতা নিয়ে দেবী লক্ষ্মীর কাছে
হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তারপর ১১টি পাতা ভেঙ্গে ময়দা রাখার পাত্রে
রেখে দিন। এর জেরে অর্থ ও লাভের যোগফল তৈরি হয়।
৪) চাকরি ও ব্যবসায় উন্নতির জন্য তুলসী গাছে হলুদ কাপড়ে
বেঁধে বৃহস্পতিবার অফিসে বা দোকানে রেখে দিন। এতে ব্যবসা বাড়ে ও চাকরিতে
পদোন্নতির সম্ভাবনা তৈরি হয়।
তুলসী
গাছের ঔষধি গুণাগুণও রয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। এর পরের লেখনীতে আমরা আলোচনা করব তুলসী
গাছের ঔষধি গুণের ব্যাপারে।
FAQ
প্রঃ- কোন দিন তুলসী গাছে জল দিতে নেই?
উঃ রবিবার তুলসী গাছে জল দিতে নেই।
প্রঃ- তুলসী গাছের প্রকারভেদ
উঃ- ১) শ্যামা তুলসী
২) রাম তুলসী
৩) শ্বেত তুলসী
৪) বন তুলসী
৫) লেবু তুলসী
প্রঃ- তুলসী গাছের ইংরাজী নাম কি?
উঃ- তুলসী গাছের ইংরাজী নাম Holy Basil।
প্রঃ- তুলসী গাছ মরে গেলে কি হয়?
উঃ- তুলসী গাছ মরে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়াকে অশুভ বা নেতিবাচক শক্তি বলে মনে করা হয়।
প্রঃ- তুলসী গাছের বৈশিষ্ট্য
উঃ- তুলসী গুল্ম প্রকৃতির উদ্ভিদ, এর উচ্চতা ৩ফুটের মত হয়। সারা বছরই তুলসী গাছে সবুজ পাতার সমাহার দেখা যায়, এর পাতার কিনারা খাঁজ কাটা বিশিষ্ট এবং এর পাতা, ফুল ফল ঝাঁঝালো গন্ধ বিশিষ্ট। জুলাই-আগষ্ট অথবা নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে তুলসী গাছে মঞ্জুরী হতে দেখা যায়।
0 মন্তব্যসমূহ